এ নহে তোমার !!

নহে তোমার !!   হাসান মাহমুদ

মোটামুটি দু’হাজার তিনশো বছর আগে।

বাংলা থেকে হাজার মাইল দূরে পঞ্চ আব অর্থাৎ পঞ্চনদীর দেশ পাঞ্জাবের বিপাশা নদীর ধারে এসে দাঁড়িয়েছেন সুদূর গ্রীসের বিশ্বজয়ী শক্তিশালী সম্রাট। কোথায় কত দূরে সেই গ্রীস ! সেখান থেকে শুরু করে কত রাজ্য, কত দেশ, তুর্কিস্থান, ইরাণ, আফগানিস্থান হয়ে পাঞ্জাব। জয়ের পর জয়। শক্তিশালী তাঁর বাহিনীর সামনে মাথা নত করেছে শত শত রাজ্য। কিংবদন্তীর নায়ক বিশাল পারস্য সাম্রাজ্যের সম্রাট দারায়ূস পর্যন্ত দাঁড়াতে পারেনি তাঁর সামনে। মানুষের ইতিহাসে এত বিজয় কখনও দেখেনি কেউ। সম্রাটের চোখে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন। ওটা তাঁকে মানায়। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনীর অধিকারী তিনি। সর্বশ্রেষ্ঠ যুদ্ধ বিশারদ তাঁর সেনাপতি। বারবার প্রমাণ হয়েছে সেটা।

ঝিলমিল করছে বিপাশার ঢেউ। ওই দেখা যায় বিপাশার ওপারে ভারতের মূল ভূখণ্ড। আর মাত্র কটা দিন। তারপরেই গোটা ভারতবর্ষ তাঁর হয়ে যাবে। সেই সাথে পূর্বভারতের গঙ্গার সেই চির সবুজ সুজলা সুফলা দেশটি। দেবার জন্য তৈরি হয়েই আছে যে মাটি। আম খেয়ে আঁটিটা ছুড়ে ফেললে পরদিন দেখা যাবে নধর দু’টি ছোট্ট সবুজ পাতা। আশ্চর্য ! এমন মাটিও আছে দুনিয়ায়!

খবর এল, নদীর ওপারে বিপক্ষ দলের সেনাবাহিনী এসেছে। তাতো আসবেই!  নিজের রাজ্য সহজে ছাড়তে চায় না কেউ। মনে মনে তৈরি হয়ে গেলেন সম্রাট। তৈরি হয়ে গেল বিপাশাও। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম দুটো শক্তি তার এধারে ওধারে। যুদ্ধ শুরু হলে পানির চেয়ে বেশি রক্ত বয়ে যাবে বিপাশা দিয়ে। কিন্তু সেনাপতির মুখ গম্ভীর কেন? গম্ভীর এজন্য যে বিপক্ষ দলের শক্তির খবর এসেছে এবং সে শক্তিটা কল্পনা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

“ক’হাজার ওরা ?” প্রশ্ন করলেন সম্রাট।

“দু’শো, সম্রাট।”

“মাত্র দু’শো?”

“আপনি হাজার জিজ্ঞেস করেছেন সম্রাট। ওরা দুশোটা এক হাজার সম্রাট, অর্থাৎ দু’লক্ষ।”  

কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল সম্রাটের।

“আরো আছে, সম্রাট। দু’দশ নয়, কুড়ি হাজার অশ্বের একটা সুসজ্জিত বাহিনী তৈরী হয়ে আছে”।

ভুরু কুঁচকে গেল সম্রাটের। কু-ড়ি হা-জা-র ঘোড়ার বাহিনী ! 

আরো আছে, সম্রাট। কমপক্ষে তিন হাজার হাতির একটা বাহিনী মারমুখো হয়ে আছে।”

মুখ হা' হয়ে চোয়াল ঝুলে পড়ল সম্রাটের। অবিশ্বাস্য, অবিশ্বাস্য ! দু’চারশো নয় তিন তিন হাজার হাতির যুদ্ধ বাহিনী! এরকম শক্তি নিয়ে লোকটা ভারতবর্ষে বসে করছে কি? সমস্ত পৃথিবীটাতো ওরই জয় করার কথা! সম্রাটের মনে হলো পুরো হিমালয় পর্বতটা উঠে এসে তাঁর পথরোধ করে দাঁড়িয়ে গেছে। জীবনে অসংখ্য যুদ্ধে তিনি কখনও পরাজিত হননি। কিন্তু হিমালয়ের সাথে কি যুদ্ধ করা যায়? ব্যাকুল হয়ে তাকালেন তিনি সেনাপতির দিকে।

‘স্রেফ আত্মহত্যা করা হবে, সম্রাট’। জানালেন অভিজ্ঞ যুদ্ধ বিশারদ, রণ নিপুণ সেনাপতি।

গল্প মনে হচ্ছে ? রূপকথা ? বুঝি রূপকথা সৃষ্টি করার অসম্ভব ক্ষমতাই ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের। দিগি¦জয়ী বন্যা ঠেকিয়ে দেবার ক্ষমতা ছিল। রূপকথা নয়, বাস্তব। বিদেশি ঐতিহাসিকদের সপ্রশংস লেখনীর ইতিহাস। সেই লেখনীর দিকে তাকানো যাক একবার।

“ধননন্দ গঙ্গারিডি জাতির রাজা ছিলেন। আলেকজাণ্ডারের বিপক্ষে তাঁর বাহিনীতে প্রায় দু’লক্ষ পদাতিক, বিশ হাজার অশ্বারোহী এবং তিন থেকে চার হাজার যুদ্ধ হস্তী ছিল” - কুইণ্টার্স কার্টিয়াস।

“ভারতবর্ষের সমুদয় জাতির মধ্যে গঙ্গারিডিই সর্বশ্রেষ্ঠ। এই গঙ্গারিডির রাজার বিশাল হস্তীবাহিনীর কথা জানিতে পারিয়া আলেকজাণ্ডার তাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হইলেন না” - ডায়াডোরাস।

কিন্তু তাতে বাংলার কি ? বাঙালির কি ? কোথাকার এক গঙ্গারিডি জাতির রাজা বিপাশা পর্যন্ত বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হলেনই বা। ‘অপরিসীম শক্তির অধিকারী’ হলেনই বা। তাতে আমাদের বাঙালিদের কি আসে যায় ?  আবার তাকানো যাক বিশ্ববরেণ্য ঐতিহাসিকদের দিকে।

“গঙ্গা নদীর মোহনায় সমুদয় এলাকা জুড়িয়া গঙ্গারিডিদের রাজ্য” - টলেমি।

“গঙ্গারিডি সাম্রাজ্যের ভিতর দিয়া গঙ্গা নদীর শেষ অংশ প্রবাহিত হইয়াছে” - প্লিনি।

মিলে গেলনা অঙ্কটা ?

(লেখকের "বাংলার কথা কই - গল্পচ্ছলে বাংলার ইতিহাস" বইয়ের একটি অধ্যায়:- https://hasanmahmud.com/index.php/books/33-bangla/280-2024-04-24-16-47-55 )

 

&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&  

Print